Blog Details

Home Blogs

blog-img01

শিরোনামহীন উপাখ্যান

আমার মাতামহী বার্ধক্যজনিত কারণে বেশ কিছুদিন অসুস্থ কিন্ত পুরোপুরি শয্যাশায়ী ছিলেন না। অনেকদিন থেকে খুব ইচ্ছে নানীকে দেখার……….অনেকদিন দেখিনি। ব্যস্ততা কী আর সহজে ছাড়ে? তার উপর মা’র আকস্মিকভাবে ধরা পড়লো Papillary Carcinoma। ডাক্তার বললেন ক্যান্সার তবে ঢোঁড়া সাপের বিষের মতো। অতো বিচলিত হবার কিছু নাই ……… আবার গড়িমসি করাও ঠিক হবেনা। আমরা বিচলিত না হয়ে ২য় টিকেই বেছে নিলাম। গড়িমসি না করে পাঁচ দিনের মধ্যেই আল্লাহর রহমতে সফল অস্ত্রোপচার। এবার ডাক্তার দিলেন Radio Iodine Ablation থেরাপী, সেই সাথে প্রায় মাস খানেকের নি:সঙ্গ যাপন। পিজি হাসপাতালের Nuclear Medicine Institute হতে থেরাপীর দিন ধার্য্য হলো নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি। হাতে কিছুদিন বাকী মানে এটাই ভালো সময় মাকে নানীকে দেখিয়ে আনার। সময়মতো বিমানের টিকেট নাই। সিদ্ধান্ত হলো সরাসরি গাড়ী নিয়েই রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ২৭০ কি.মি. যশোহর জেলার শার্শা থানার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী কায়বা ইউনিয়নের বাইকোলা গ্রাম।ওখানেই নানী থাকেন। বেড়ানোর জন্য নাঁচুনি বুড়ি আমার বেটার হাফ, বউ বাক্সপেটরা গুছিয়ে শাশুড়ির আগে নিজেই তৈরী। নানা শ্বশুর বাড়ী বলে কথা। টাকা খরচ? হোক না কিছু, Gift নিতেই হবে সবার জন্য। খবর পেয়ে অজুহাত অন্বেষী ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মামাতো ভাইটিও তৈরী। চুলোয় যাক লেখাপড়া। আগে দাদার বাড়ী। আমার আবার মালয়েশিয়ান ডেলিগেটদের সাথে দিনভর মিটিং। নাহ্ একি সহ্য হয়? বাপ যা বলবি বল, যা খাবি খা, যা নিবি নে কিন্তু বেলা তিনটের আগে বিদেয় হ। আমার সামনে এখন শুধুই নানার বাড়ি।
নানাভাই গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগেই। দাদার বাড়ী দেশের উল্টো দিকে হলেও এই অজপাড়া গ্রামটির প্রতি আমার টান অন্য রকম। হয়তো জন্মগত কারণে। নানা-নানীর নয় ছেলেমেয়ের বিশ/বাইশটি সুদর্শন-সুশ্রী নাতী-নাতনীর ভেতর কৃষ্ণবর্ণের আমার প্রতি তাঁদের ঈর্ষান্বিত অগাধ স্নেহ-মমতা আজো গবেষনার বিষয়ের মতো। কোন বায়না নানার বাড়ীতে আমার পুরন হয়নি, এমনটি মনে নেই।
অবশেষে, ২৭ তারিখ বিকেল ৪টা। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। গন্তব্য বাপের শ্বশুর বাড়ি। সামনের সিটে মামাতো ভাইটি আর পেছনে আমি, মা আর তার ছেলের বউ, আমার অর্ধাঙ্গিনী।বাইরে বৃ্ষ্টি আর মাথার ভেতর আমার যত প্ল্যান: পুকুর থেকে মাছ ধরা, ছাগল কেনা আর রাতে পিকনিক। বয়েস না হয় ৩৫/৩৬ পেরিয়েছে, তাতে কি? একি আর কোটাযুক্ত সরকারী চাকুরি। সাভারে পর্যটনের জয় রেস্তরায় যাত্রা বিরতি, মামাশ্বশুরের রাজসিক আপ্যায়ন। জামাই বলে কথা।
যাত্রা আবার শুরু। কানে মামাতো ভাইয়ের ধার করা হেডফোন। চোখ গাড়ির সামনের ট্রাকের পেছনে ‘ সম্পদ খাবে লোকে, দেহ খাবে পোকে।’ ধুর, এ সব আজকের জন্য না। ”আজি যত তারা তব আকাশে।”
সেজো মামার শহরের বাসায় রাত যাপন। পরদিন বড় মামার বাসায় দুপুরে খাওয়া। বউ নিয়ে আসছি, আগে শহরের একেকজন মামার বাড়ি তারপর গ্রাম। এ জগতে হায় কে পিঠের ছাল হারাতে চায়…..?
বড় মামার বাসায় দুপুরের ভোজ শেষ। গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু আবার। সাথে আমার আহ্লাদী বউ আর গ্রাম বিমুখ মামাতো ভাই। বিদেশে থাকা আমার বোনের ভিডিও কল। স্বামী আর বাচ্চাদের নিয়ে ম্যাসেঞ্জারে তারও জন্মস্থান দেখার আবদার। হাতে আমার আইফোন ৬। ম্যাসেঞ্জারে ভিডিও কল অন আর আমি ভিডিও ম্যান। এপাড়ে কচার বেড়া, আমের বাগান, গাঁজীদের পুরনো শাঁনবাধা ঘাট, জমিদার বাড়ি, সর্দার পুকুর, ওমরের ক্ষেত আর ফোনের ওপাড়ে বোন আর তার পুরো উচ্ছাসী পরিবার।দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো চেষ্টা, আর কি।
আসার খবর পেয়ে আমার ৩খালা হাজির আগেই। বাড়ির উঠোনে ইলিশ মাছ কাটাকুটি, রান্নাঘরে আমার পছন্দের কবুতর রান্নার ব্যস্ততা। আমি বউ নিয়ে নানীর ঘরে। নানী আম্মার হাতে আঙ্গুর খাচ্ছেন। অসুস্থতার কোন লক্ষণই নেই।
মাগরিবের আযান।
সালাম দিয়ে বললাম, নানী বলেন তো, আমি কে?
নানী তাকিয়ে বললেন- ‘চিনতে তো পারছিনে’
সেজো খালা চিনিয়ে দিলেন, ‘এ যে আমাদের মাসুম, চিনতে পারছেন না কেন, আর এ যে আমাদের বউ মা। আর কিরন।’
নানী চিনলেন, ‘ও মা মাসুম! সোনা নানু ভাই আমার তুই এয়েছিস।’–আরো কতো যে মমতা মাখানো কথা।
জড়িয়ে ধরলেন আমাকে আর আমার বউকে, কপালে আর গালে চুমু খেলেন। আমি একটু সরে এলাম, আমার জায়গায় নানীকে জড়িয়ে ধরে বসলো সাথে থাকা মামাতো ভাই কিরন, নানীর বড় ছেলের একমাত্র ছেলে। নানী তাকেও আদর করলেন।
কিরন বললো: ‘বু আপনি মন খারাপ করবেন না। সব সময় আমাদের জন্য দোয়া করবেন। নামাজ পড়বেন, আর যিকির করবেন। আমার সাথে বলেন, লা ইলাহা ইল্লালাহু…
আমি চেয়ে থাকলাম, নানী কিরনের সাথে বলতে থাকলেন..’লা ইলাহা ইল্লালাহু….’ সাথে সাথেই জোর এক নি:শ্বাস ছাড়লেন……আর ঘাড়টি নিচের দিকে ছেড়ে দিলেন।
কিরন চিৎকার দিলো রান্নাঘর থেকে সবাই ছুটে আসলো। আমি দৌড়ে হাত ধরে পালস্ দেখলাম। পালস্ পাওয়া গেল..১, ২, ৩ নাহ্ পুরিপুরি থেমে গেল। হাত ছেড়ে সরে এলাম। ঘরে তখন …..আমার বউ, কিরন.. হত বিহব্বল। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
উঠোনে বেরিয়ে এলাম। আকাশের দিকে তাকালাম। মানুষ মরে গেলে নাকি তারা হয়ে যায়। আমি আমার নানীর তারাটিকে খুজলাম। আজ আকাশের মন খারাপ। মেঘে ঢাকা আকাশ।
মসজিদের মাইকে তখন মাগরিবের জামাতের কিরাত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *